অ্যালকোহলের সাতসতেরো
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই বৈধভাবে হোক বা অবৈধভাবে হোক অ্যালকোহল পান করা হয়। আমেরিকায় যখন শিল্প বিপ্লব চলছিল তখন প্রতি সপ্তাহের সোমবারে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ তাদের কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকতো। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, রোববার ছুটি পেয়ে রাতের বেলা এতো বেশি অ্যালকোহল পান করতো যে, মঙ্গলবার পর্যন্ত মদের নেশায় তারা বেসামাল থাকতো। এর পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল পানের ফলে নানা সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হতো। তারা যে আয় করতো তার বেশিরভাগ অ্যালকোহলের পিছনে খরচ করে ফেলতো। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে তাদের পরিবারের লোকজনদের দৈনন্দিন খরচ চালাতে তারা ব্যর্থ হতো। অনেকে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে স্ত্রী-সন্তানকে নির্যাতন করতো।
ব্রিটিশ পর্যটক ও লেখক ফ্রেডরিক মেরিয়েট, আমেরিকা ভ্রমণের পর, আমেরিকানদের মাত্রাতিরিক্ত পান আসক্তি দেখে অবাক হয়েছিলেন। তাঁর লেখা বই ‘অ্যা ডায়রি ইন আমেরিকা’ বইতে লিখেছিলেন‘তারা কারো সাথে দেখা করলে পান করে, আলাপচারিতায় যখন কোনো অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তখনও তারা পান করে। পছন্দসই পণ্য কিনার আনন্দে তারা পান করে আবার পছন্দসই পণ্য কেনার ব্যর্থতায়ও তারা পান করে। ঝগড়ার পর তারা পান করে, ঝগড়া মীমাংসার সময়ও তারা পান করে। আবহাওয়া উষ্ণ হলেও তারা পান করেশীতল আবহাওয়ায়ও তারা পান করে। সুখের সময় তারা পান করে আবার দুঃখে পড়েও তারা পান করে। তাদের সকালের শুরুটা হয় পানের মাধ্যমে আবার রাতে ঘুমানোর আগেও তারা পান করে ঘুমায়। অ্যালকোহল পান করার আগে তারা কোনো কাজই করতে পারে না। জীবনের প্রথমদিকে শুরু করা পানের অভ্যাসকে তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বজায় রাখে।
মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল আসক্তি আমেরিকান প্রশাসনের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯১৯ সালে ৬৬তম কংগ্রেসের আইনসভায় প্রস্তাব করা হয়—আইন প্রণয়ন করে অ্যালকোহলের উৎপাদন, বিক্রয় ও পান বন্ধ করা হবে। প্রস্তাবটা বিপুল ভোটে আইনসভায় পাশ হয়। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের জুডিশিয়াল চেয়ারম্যান অ্যান্ডরু ভোলস্টিডের নামানুসারে আইনটির নাম দেওয়া হয়‘দ্যা ভোলাস্টিভ অ্যাক্ট’।
১৯২০ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকার সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে অ্যালকোহন তৈরি, বিপণন, আমদানি ও পরিবহন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময়কালকে আমেরিকায় ‘প্রহিবিশন’ যুগ বলে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আইনটি করা হয়েছিল কার্যতো তার উল্টো ফল হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর অ্যালকোহলের উৎপাদন, বিক্রি পুরোটাই অপরাধী চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
অ্যালকোহল নিষেধাজ্ঞার পক্ষে জনসমর্থন একেবারেই না থাকায়, নিষেধাজ্ঞা আরোপের ১৩ বৎসর পর, সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়। প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিং, হোয়াইট হাউসে প্রকাশ্যে মদ পরিবেশন করতেন।
১৯৩২ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার এক বৎসর পর ‘ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট’ অ্যালকোহলের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। চারপাশে অ্যালকোহলের ছড়াছড়ির পরওআমেরিকার কিছু মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন আমেরিকায় অ্যালকোহল আবার নিষিদ্ধ হবে। তখন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অ্যালকোহল পানকারীদের বিরাট চাহিদাকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজে ব্যবহৃত অ্যালকোহল; যেগুলো মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক, সেগুলোর আর প্রসার ঘটাতে পারবে না।
আমেরিকান তরুণ সমাজের অ্যালকোহল প্রীতি এখন শুধু অ্যালকোহলেই সীমাবদ্ধ না, তার সাথে যোগ হয়েছে ক্যাফেইন। মিশিগান, ওকলাহোমো, ইউটা, ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে ইতোমধ্যে অ্যালকোহল মিশ্রিত ক্যাফেইন বিক্রি নিষিদ্ধ হয়েছে। রাজ্যগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও তরুণদের রক্ষায় ক্ষতিকর ঐসব পানীয় বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। সিনেটর ‘চার্লস শুমার’ উত্তেজক পানীয় নিষিদ্ধ করার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।