৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারােহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। দিনমণি অস্তাচলগমনােদ্যোগী দেখিয়া অশ্বারােহী দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলে... See more
৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারােহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। দিনমণি অস্তাচলগমনােদ্যোগী দেখিয়া অশ্বারােহী দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। কেন না, সম্মুখে প্রকান্ড প্রান্তর; কি জানি, যদি কালধৰ্ম্মে প্রদোষকালে প্রবল ঝটিকা বৃষ্টি আরম্ভ হয়, তবে সেই প্রান্তরে, নিরাশ্রয়ে যৎপরােনাস্তি পীড়িত হইতে হইবে। প্রান্তর পার হইতে না হইতেই সূৰ্য্যাস্ত হইল; ক্রমে নৈশ গগন নীলনীরদমালায় আবৃত হইতে লাগিল। নিশারম্ভেই এমন ঘােরতর অন্ধকার দিগন্তসংস্থিত হইল যে, অশ্বচালনা অতি কঠিন বােধ হইতে লাগিল। পান্থ কেবল বিদ্যুদ্দীপ্তিপ্রদর্শিত পথে কোন মতে চলিতে লাগিলেন।........
Bankim Chandra Chattapadhyaya- জন্ম হয় বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তারিখ ২৬ জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের পূর্বে তাঁর আরও দুই পুত্র জন্মান – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের কণিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনওদিনই যান নি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তাঁর গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হন নি। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।” ১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন। ১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন; তাঁর কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁটালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁটালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাঁকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তাঁর পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল। কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু। তার বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত। শেষ জীবনে তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে তাঁর মৃত্যু হয়, এপ্রিল ৮, ১৮৯৪ (বাংলা ২৬ চৈত্র ১৩০০ সাল)
'দুর্গেশনন্দিনী' বাংলা সাহিত্যের এক পরম বিস্ময়ের নাম। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সার্থক উপন্যাস এটি। এই উপন্যাসের রচনাকাল ১৮৬২-৬৩ এবং প্রকাশকাল ১৮৬৫। এই উপন্যাস রচনার সময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বয়স ছিল চব্বিশ থেকে ছাব্বিশ বছর। শেষোক্ত তথ্যটা কি অবাক করার মত নয়? বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের বয়স আজ প্রায় ১৫০ বছর হতে চলল কিন্তু এখনো অনেক সাহিত্যিককে নিজের জীবনের সেরা লেখাটা লিখতে আজীবন মাথাকুটে মরতে হয়। সেখানে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সী এক যুবক কি করে এত চমৎকার একটা উপন্যাস লিখে ফেললেন যা কিনা শুধু বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাসই নয় বরং আজো বিবেচিত হয় বাংলা ভাষায় রচিত অন্যতম সেরা উপন্যাস হিসেবে, তা ভাবতে গিয়ে শুধু গলদঘর্মই হতে হয়। সত্যি, বঙ্কিমচন্দ্র আসলেই একজন জিনিয়াস!
'দুর্গেশনন্দিনী' উপন্যাসের পটভূমি ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মুঘল ও পাঠানের সংঘর্ষ। তারমানে যে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, সেটিরও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ইতিহাসেরই উর্বর জমিনে! দিল্লীশ্বরের সেনাপতি মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহ মাত্র ৫ হাজার সৈন্য নিয়ে বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছিল পাঠানদের ওপর। এক পর্যায়ে মান্দারণ যাত্রাকালে ঝড়ের কবলে পড়ে এক মন্দিরে আশ্রয় নেয় সে। সেখানেই সে দেখা পায় দুই রমণীর, একজন যুবতি আর একজন সদ্য যৌবনা তরুণী। তরুণীর প্রেমে পড়ে যায় জগৎসিংহ। কিন্তু সেবারে তরুণী ও তার সখির পরিচয় জানতে ব্যর্থ হয় জগৎসিংহ। পরেরবার তরুণীর সেই সখি বিমলার কাছ থেকে সে জানতে পারে সেই তরুণী ছিল মান্দারণের দুর্গাধিপতি বীরেন্দ্র সিংহের কন্যা তিলোত্তমা। বিমলার সাথে জগৎসিংহ চলে তিলোত্তমার সাথে দেখা করতে। কিন্তু জগৎসিংহ সেখানে থাকাকালীনই, পাঠানরা দখল করে বীরেন্দ্রসিংহের দুর্গ। সকলের সাথে জগৎসিংহও বন্দি হয়। বন্দি অবস্থায় পাঠান সেনাপতি কতলু খাঁ'র কন্যা আয়েষা প্রেমে পড়ে জগৎসিংহের। তারপর কি হবে? জগৎসিংহ কি মুক্ত হতে পারবে? বিমলা, তিলোত্তমা, বীরেন্দ্রসিংহেরই বা কি হবে? আর শেষ পর্যন্ত জগৎসিংহের হৃদয় জয় করবে কে? আর বিজিতের কি পরিণতি হবে? এমন নাটকীয়ভাবেই আবর্তিত হয়েছে 'দুর্গেশনন্দিনী' উপন্যাসের কাহিনী।
'দুর্গেশনন্দিনী' পাঠের অভিজ্ঞতা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার ভাষা যেমন বেশ কঠিন, তেমনি লেখার ভাবও অনেক কঠিন। তাই তাঁর লেখা পড়তে আক্ষরিক অর্থে দাঁত ভাঙার জোগাড় না হলেও, বাংলা ভাষায় যাদের বেশ ভালো দখল আছে তাদেরও কখনো কখনো একটু হলেও হোঁচট খেতে হয়। কিন্তু তারপরও বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় কেমন যেন একটা কাব্যময়তা আছে যা পাঠকের মনে মাদকতার সৃষ্টি করতে বাধ্য। তাই একবার বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা পড়তে শুরু করলে যত কষ্টই হোক, শেষ না করে ওঠা অসম্ভব। পাশাপাশি 'দুর্গেশনন্দিনী' উপন্যাসের কাহিনীও এতই আকর্ষনীয় ও চির তরুণ যে, খুব সহজেই এই উপন্যাস পড়তে পড়তে ধরতে পারা যায় সেই ষোড়শ শতাব্দীর সময়কার আবহকে।
আর বেশি কথা খরচ করব না এই উপন্যাস নিয়ে। কিন্তু একটা কথা না স্বীকার করে উপায় নেই যে লেখক উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি চরিত্রকেই সমান মমতার সাথে নির্মাণ করেছেন তাই একটা পর্যায়ে এসে আমার কাছে প্রতিটি চরিত্রকেই অনেক বেশি আপন বলে মনে হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে জগৎসিংহ আর তিলোত্তমা অপেক্ষা বিমলা আর আয়েষা চরিত্র দুটি অধিক আকৃষ্ট করেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যারা স্রেফ একটা প্রেমকাহিনীর চেয়েও অনেক বেশি কিছু পেতে চান, তারা অবশ্যই 'দুর্গেশনন্দিনী' উপন্যাসটি পড়ে দেখবেন।