আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান বাংলার কিংবদন্তী। বিভিনড়ব সময় তিনি মুখোমুখি হয়েছেন বিভিনড়ব কলাব্যক্তিত্বের সাথে, বলেছেন নিজের সবটুকু খুলে। সেসব চমৎকার সাক্ষাৎকারের রুচিকর... See more
আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান বাংলার কিংবদন্তী। বিভিনড়ব সময় তিনি মুখোমুখি হয়েছেন বিভিনড়ব কলাব্যক্তিত্বের সাথে, বলেছেন নিজের সবটুকু খুলে। সেসব চমৎকার সাক্ষাৎকারের রুচিকর ও আভিজাত্যিক সংগ্রহ মুখোমুখি সুলতান।
জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২, যশোর জেলার শেখপুরা গ্রামে। মূলত কবি। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। গান লেখেন। সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও রয়েছে তাঁর শৈল্পিক পদচারণা। মধুসূদন চর্চা ও গবেষণা তাঁর প্রিয় বিষয়। খসরু পারভেজের মধুসূদনবিষয়ক কাজ রচিত বই : মাইকেল পরিচিতি, সাধিতে মনের সাধ ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত। অনুবাদ : মধুসূদনের চিঠি। এছাড়া মধুসূদনবিষয়ক দু ডজনের বেশি পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। নিজ প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন মধুসূদন স্মারক সংস্থা ‘মধুসূদন একাডেমী’ ও কবি সংগঠন ‘পোয়েট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : কাব্য : পালকখসা বলাকার আর্তনাদ, নিহত বিভীষিকা, নিরুদ্দেশে, মুক্তিযুদ্ধে কুকুরগুলো, ভালবাসা এসো ভুগোলময়, পুড়ে যায় রৌদ্রগ্রাম, ধর্ষণ মঙ্গলকাব্য, রূপের রিলিক, প্রেমের কবিতা, জেগে ওঠো প্রত্মবেলা, হৃদপুরাণ। গবেষণা : পদ্য : কবিতার ছন্দ, আমাদের শিল্পী এস এম সুলতান, আমাদের বাউল কবি লালন শাহ, এস এম সুলতান, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত। পুরস্কার ও সম্মাননা : সুকান্ত পদক, মনোজ বসু স্মৃতি পুরস্কার, কণ্ঠশীলন সম্মাননা, বিবেকানন্দ পদক, মধুসূদন সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, জীবনানন্দ গ্রন্থাগার সম্মাননা। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান পদক, ফেডারেশন হল সোসাইটি সম্মাননা (ভারত)। তাঁর পিতা মরহুম খন্দকার মকবুল আহমেদ, মাতা লুৎফুন্নেছা লতা। কর্মজীবনে তিনি সোনালি ব্যাংকের কর্মকর্তা।
এস এম সুলতানকে নিয়ে বেশ কৌতূহল কাজ করছে আমার মধ্যে বেশ দীর্ঘদিন ধরে। আহমদ ছফার "যদ্যপি আমার গুরু" পড়ার পর থেকেই এ কৌতূহলের জন্ম। অনলাইনে তাঁর আঁকা ছবিগুলো দেখেছি, সাথে সাথে তাঁকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোও পাঠ করেছি। নানা কারণে তাঁকে নিয়ে লেখা কোনও বইয়ের সাথে সংযোগ আমার ঘটেনি। আমার পরিচিত শিল্পী বলয়ে সুলতান নিয়ে কিছু জানার আগ্রহ যেই প্রকাশ করেছি, দুয়েকজন বাদে প্রায় সকলেই নেশা-ভাঙ আর কিছু মিথই ঘুরেফিরে শুনিয়েছেন।
"আমি চাক্ষিক রূপকার মাত্র" পড়ার পর রামকিঙ্করকে নিয়ে যে আমার আগ্রহের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল, তার কারণে আমি সুলতানকে নিয়েও ঠিক এমন ধাঁচের বইয়ের সন্ধান করছিলাম। ফলে, গত এক বছরে খসরু পারভেজ সম্পাদিত "মুখোমুখি সুলতান", সৈয়দ নিজারের "ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা" এবং হাসনাত আবদুল হাইয়ের" সুলতান" সংগ্রহ করি। কিন্তু পাঠ করা হয়ে ওঠেনি। এক ধরনের রিডিং ব্লক কাজ করছিল। মন বসাতে পারছিলাম না।
করোনাকালীন সময়ে বুলবন ওসমানের "নন্দনতত্ত্বের গোড়ার পাঠ নাড়তে গিয়ে সুলতান নিয়ে দুটি লেখা পড়লাম। ফের অতৃপ্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। পড়ব পড়ব বলে গত সপ্তাহে "মুখোমুখি সুলতান" পড়া শুরু করলাম, বেশ আনন্দ ও তৃপ্তির সাথেই গতকাল পাঠ শেষ করলাম। ১১২ পৃষ্ঠার এই বইটি শেষ করতে সাত-আটদিন লেগে গেল। খসরু পারভেজ, শাহাদুজ্জামান, শরীফ আতিক-উজ-জামান ও বাবলু ভট্টাচার্যের নেওয়া সাক্ষাৎকার দিয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। সুলতান বিষয়ক প্রাথমিক-পাঠে বইটি আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। শিল্প, সমাজ, নগর, রাষ্ট্র, পৃথিবী, বাঙালি ও মানুষ নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনার দার্শনিক রূপ ছড়িয়ে রয়েছে বইটির পরতে পরতে। তাছাড়াও শিল্পীজীবনের পরিভ্রমণের একটা চিত্র পাওয়া যায়। কলকাতা আর্ট কলেজে পড়া, সেখানে বরাবরের মতো ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ না করেই বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আবার একজন বিশ্বজনীন বোধের মানুষের পরিভ্রমণ শেষে শিকড়ের কাছে ফিরে আসা ও তার স্বজাতির কাছে মূল্যায়িত হওয়ার বিন্দুমাত্র আশা না করে এক সন্ত-শিল্পীর জীবন ধারণ করে মাটি ও মানুষের ঘনিষ্টতর হয়ে এর বয়ান করা যেন একমাত্র সুলতানের পক্ষেই সম্ভব।
তিনি গ্রাম নিয়ে ভেবেছেন, ভেবেছেন কৃষকসমাজ নিয়ে, আর ভেবেছেন শিশুদের নিয়ে। এক জায়গায় তিনি বলেছেন,
“আমি আলাপ করি বেগম এরশাদের সঙ্গে, তাকে অনেক বুঝালাম। তাকে বললাম, আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভোররাতে কাঁদে কেন? চিৎকার করে কাঁদে, এমনকি বিছানা থেকে মাকে উঠতেই দেয় না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কাঁদে কেন? তখন তিনি বলতে পারলেন না। বললেন, আপনি বলেন। আমি বললাম যে, ওদের খিদে লাগে। সারা রাত্রি ঘুমানোর পর ওদের যখন খিদে লাগে, তখন কাঁদে। গরিবের ঘরে এমন কিছু থাকে না, যা দিয়ে সকালে ওদের কান্না থামানো যায়।’
এথেকে বোঝা যায় তার মানবিক শিশুশিক্ষাভাবনার স্বরূপ। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কীভাবে একজন শিশু ছবি আঁকা শিখবে! কীভাবে সে পড়াশোনায় মনোযোগী হবে! শিশুদের জন্য তিনি গড়ে তুলেন শিশুস্বর্গ। নির্মাণ করেন বজরা, যাতে করে নৌভ্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুরা প্রকৃতিকে রঙ তুলি দিয়ে চিত্রায়িত করতে পারে।
ইতিহাসের সাথে তাঁর চিন্তার বোঝাপড়ায় তার চিত্রকলার নির্মাণ তা তিনি বেশ সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। বারবার বিষয়বস্তু হিসেবে কৃষকসমাজ ও তাদের দানবীয় শরীরের চিত্রায়ন তিনি কেন করেছেন তাঁর ব্যখ্যাও পাওয়া গেছে বেশ চমৎকারভাবে। তিনি বলেন, “সচরাচর আমরা যা দেখে থাকি তার দৃশ্যানুগ সরল উপস্থাপনা ছবি নয়। তেমন কাজ শিল্পীর তুলির দক্ষতা তুলে ধরে মাত্র। কিন্তু তার কোনো হিউম্যান ভ্যালু থাকে না। শুধু প্লাস্টিক ভ্যালু চিত্রকলার উদ্দেশ্য হতে পারে না, তবে শিল্পীর নৈপূণ্য কৌশল তার ছবির হিউম্যান ভ্যালু ফুটিয়ে তুলতে অবদান রাখে অবশ্যই। আবার ছবির স্বাভাবিক অঙ্গ-সৌষ্ঠবের হলে তোমাদের মনে এই প্রশ্ন জাগত না। এগুলো গ্রামীণ জীবনের Photographic Representation হোট মাত্র। বক্তব্যহীন ছবি নিশ্চয় ছবি নয়। ওদের স্বাস্থবান করে চিত্রিত করার উদ্দেশ্য তিনটি বিষয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিষয় তিনটি হলো _ নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতি। নৃতত্ব বলছে, আমাদের পূর্ব-পুরুষরা খুবই স্বাস্থ্যবান ছিল, দানবীয় অঙ্গ-সৌষ্ঠবের ছিল। অনার্য জনগোষ্ঠীর মানুষ হওয়ায় তাদের রঙ, নাক, চোখ, চুল ইত্যাদি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের যা আমার ছবির মানুষের রয়েছে। ঐতিহাসিক সত্য হল, একদা তাদের প্রাচুর্য ছিল, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না, কিন্তু রাজনৈতিক চক্রান্তে তাদের সে স্বাস্থ্য হারিয়ে গেল। যুগে যুগে তারা শোষিত হল নিরন্তর এবং এই প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। আমি চাই ওদের হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাক । আমি স্বপ্ন দেখি ওদের সোনালী দিন। আমি তাকাই সামনে ও পেছনে, সময়কে অতিক্রম করে। তাই ওরা দানবীয়। তাছাড়া মানুষকে ভালোবাসলে তার প্রকাশ হওয়া চাই সুন্দর ও বলিষ্ট। আমার কাছে শক্তিই সৌন্দর্য। মাইকেল এঞ্জেলো যেমন মানুষকে Normal size থেকে Abnormal size এ নিয়ে গেছেন। তিনি মনে করেছেন, মানুষ এত বর হলে ভালো হয়। Concept of Adam-ও কিন্তু এই রকম। তার যে বর্ণনা আছে তা এই রকম”। বহু বিচিত্র বিষয়ে সুলতানের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে এ বইয়ে। কাশ্মিরে প্রদর্শনীর কথা যেমন এসে তেমন এসেছে সেখানকার সৌন্দর্য ও কৃষকের কথা। এসেছে ইউরোপে ও আমেরিকায় প্রদর্শনী পরিভ্রমণের গল্প। বিচিত্র ও বহুমাত্রিক আভায় উদ্ভাসিত শিল্পী সুলতানকে নিয়ে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন, ‘সুলতানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না’। “মুখোমুখি সুলতান” পাঠ করে মনে হলো গুন্টার গ্রাস অত্যুক্তি করেননি। তিনি বামুনের দেশে এক অতিকায় স্বাপ্নিক।