কবিতার কাছে আমি কী চাই- দুধভাত? ইলিশ মাছের তরকারী? এসব কিছুই না- গভীর রাত্রিরে আমার মা যখন কোমর ব্যাথা নিয়ে হেটে যায় কলপাড়ের আমার প্রতিটা কবিতা যেন জ্বলে ... See more
কবিতার কাছে আমি কী চাই- দুধভাত? ইলিশ মাছের তরকারী? এসব কিছুই না- গভীর রাত্রিরে আমার মা যখন কোমর ব্যাথা নিয়ে হেটে যায় কলপাড়ের আমার প্রতিটা কবিতা যেন জ্বলে তার সমস্ত পথ জূড়ে।
*ইদানীং আল্লার থেকেও বেশি ভয় পাই মানুষকে— আজান হলেই পাশের মানুষেরা কেমন চেয়ে থাকে আমার দিকে,* এটা আমার আশেপাশে দেখা চিরায়ত দৃশ্য, কিন্তু এমনভাবে কে আর ভেবেছিল? আমি যখনই কবি হাসান রোবায়েত এর লেখা পড়ি তখন এমন বিভোর হই যে চোখ বেয়ে শান্তির ঘুম নেমে আসে, তার লেখার সৌন্দর্যের গভীরতা এত প্রখর যে প্রতিটি কবিতা বারবার পড়ার পরেও ভাবার্থ বের করতে বেগ পেতে হতে হয়। ফেসবুকে কবি'র লেখা নিয়মিত পড়া হয়, নিউজফিডে না আসলে আইডি সার্চ দিয়ে বের করে পড়ে আসি। কারণ হাসান রোবায়েতের ব্যবহৃত প্রতিটা শব্দ কিংবা বাক্য আমাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়— জানার অনুপ্রেরণা যোগায়— লিখতে শেখায়।
"ব্রিজ পেরোলেই অন্য ঋতুর দেশ"— কাব্যগ্রন্থতে টানাগদ্য কবিতার সংখ্যাই বেশি, তবে 'মুসলমানের ছেলে' কাব্যগ্রন্থে ছিল সনেট। টানাগদ্য কবিতা সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ফরাসিদেশে— আরো দেড়শো বছর আগেই ফরাসিরা এই প্যাটার্নটাকে এস্টাবলিশ করে গেছে। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে এই ধারাটা একদম অধুনা। সেই হিসাবে নয়, তবুও কবি হাসান রোবায়েতের লেখার স্টাইলটা অধুনা এবং একইসাথে অনন্য। আমার মনে হয় এটাকে রোবায়েতীয় ধারা বলে অভিহিত করাটাই সমীচীন হবে। এই ধারা দিয়ে প্রভাবিত হতে হলে আপনাকে আগে নিজেকে বুঝতে ও চিনতে হবে, নয়তো তাল পাইবেন কিন্তু গুড় পাইবেন না।
*'কবরে নামানোর পর' কবিতায় যেভাবে মুনকার-নাকির ফেরেশতার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, শুধু এই উত্তর দেওয়ার অংশটুকুই আপনার জীবনবোধ পরিবর্তন করে ফেলবে। প্রতিটি কবিতা আপনাকে এমনভাবে আশ্চর্য করবে যে আপনি কোথায় হারিয়ে যাবেন, বুঝতেই পারবেন না! *'কুরবানি' কবিতাটার ভাবার্থ আমাকে একটা অভাবী শিশু সাজতে বাধ্য করেছে, যখন পড়ছিলাম মনে হচ্ছিলো যেন আমিই ঐ শিশু যার বেবুঝ ছোট্টবোনটা রান্না করা গোশতের জন্য বসে আছে থালা নিয়ে কিন্তু এমন দিনেও তাদের কেউ গোশত দিতে আসেনি। পড়ার পর শেষ লাইনটার মতো আমার মাথাও হলুদ বন থেকে উড়ে আসা পাতার মতো নির্জনে নিচু হয়ে গেছে! আমি ভাবি আমার আব্বা যখন অসুস্থ হয়, তখন তো আমারও একই অবস্থা হয়। কবির কবিতা জীবনের সাথে এতই গভীরে কানেক্টেড। *'কোনো কোনো দুপুরে' কবিতায় একাকীত্বের ভয়কে এত নিদারুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যেন আমাদের কোথাও জীবন নাই।
কবি তার লেখায় আমাদের জীবনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা বেদনাগুলো এমন সরল-সাবলীল উপমায় তুলেছেন যে আমি নিজেকে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি বারবার, দুঃখ আমাকে বাবলাকাঁটার মতো আঁকড়ে ফেলেছে, ইচ্ছে করে নিজেকে ছুটি দিয়ে ব্রিজটা পার হয়ে যাই— পাবো কি অন্য ঋতুর দেশ? অথবা যদিও পেয়ে যাই— সেই দেশটা কাদের নিয়ে হবে— যারা মৃত্যু ভেবে ভেবে 'আল্লা গো' বলে নবীপ্রেমে পাগলপারা হয়েছে তাদের— নাকি পরিবার ছাইড়া আসা হোস্টেল জীবন!—?
রিভিয়্যুতে খুবই স্বল্প আলোচনা করেছি, এর আগেই অন্যান্য রিভুয়্যুদাতারা বইটা নিয়ে পোস্টমর্টেম করে ফেলেছে, ফলে আমি যেটুকু ফাঁকা পাইছি— মোটামুটি সেটুকুই পূর্ণ করতে চাইলাম আরকি— 'মুসলমানের ছেলে' কাব্যগ্রন্থের মতো 'ব্রিজ পেরোলেই অন্য ঋতুর দেশ' পাঠকপ্রিয় হোক— জনপ্রিয় হওয়ার প্রয়োজন একদমই নাই কারণ আগেই বলেছি, "আপনাকে আগে নিজেকে বুঝতে ও চিনতে হবে, নয়তো তাল পাইবেন কিন্তু গুড় পাইবেন না।" বাংলা কবিতাকে আপনি যা দিয়ে যাচ্ছেন হয়তো সেই ঋণ পাঠক হিসেবে আমরা কেউই কোনদিন শোধ করতে সক্ষম হব না। কারণ “ঝরাপাতা কি হেমন্তের ঋণ শোধ করতে পারে কখনো?”