এ যেন মােহরের জীবনবােধেরই সারাৎসার, তার দুশ্চর সাধনার বীজমন্ত্র, দুর্দম সংকল্পের উচ্চারণ। কিন্তু এই উচ্চারণ কোথায় পৌঁছে দিল মােহরকে? সেই মােহর—ছােট্টবেলা থেকে যাকে ছেলে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, অভিধান ঘেঁটে বাবা যার নাম ‘মােহর’ রেখেছিলেন এই ভেবে যে, চট করে বােঝা যাবে না মােহর নারী না পুরুষ। অনেকদিন পর্যন্ত ছেলে হয়েই ছিল মােহর। ফুটবল খেলত ভাল, জুডাে শিখেছিল কষ্ট করে, ভয়ডরও ছিল না তেমন। তবু একসময় প্রকৃতির নিয়মেই মােহর নিজেকে আবিষ্কার করল অন্য চেহারায়। জীবনে শুধু মেয়েমানুষ হয়ে নয়, সর্বোপরি মানুষ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল মােহর। এ-কাহিনী মােহরের সেই মানুষ পরিচয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টার কাহিনী। অন্যরকম, আলাদা স্বাদের কাহিনী।
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।
উপন্যাসটি লেখা এক মেয়েকে নিয়ে। যার নাম মোহর। বাবা অন্নদা মুখার্জী একজন স্কুল টিচার। মোহরের জন্মের পর থেকেই তাকে ছেলে সাজিয়ে রাখা হয়। শার্ট-প্যান্ট পড়িয়ে ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে চুল কেটে রাখা হতো। দেখলে কেউ বলতোই না, ও যে মেয়ে।
এভাবে চলার কারণে স্কুলে ওর কোন মেয়ে বন্ধু ছিলো না। ওর সাথে সবসময়ই ছেলেরাই মিশতো। এবং মোহর নিজেও সবসময় ভাবতো, একটা ছেলে যা পারে ওকেও তা পারতে হবে।
ফুটবল খেলায় গোলকিপার হিসেবে মোহরের রেকর্ড সেরা। বন্ধুদের সাথে রাগারাগি করে ঠিক করে সে জুডো শিখবে। মায়ের আপত্তি থাকলেও বাবা অন্নদা মুখার্জী সবসময় তার পক্ষে ছিলেন। তাই মেয়ের জুডো শিখতে তার কোন আপত্তি ছিলো না। সবসময়ই মেয়ের পাশে থেকেছিলেন ছায়ার মতো।
উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর মোহরকে বাধ্য হয়েই কলকাতা পাঠাতে হয়। অনন্দা মুখার্জীর কাকা গোলকপতি ব্যানার্জী। কলকাতায় আসার পর আবার আগের মতোই অনেক ছেলে বন্ধু জুটে যায় মোহরের। ক্যাফেতে একসাথে আড্ডা- ভালোই চলছিলো মোহরের দিন। এর মধ্যেই হটাৎ পরিচয় হয় দীপ্ত নামের এক ছেলের সাথে। হ্যাঁ দীপ্ত সেন। মোহরের বন্ধু সৌমিত্রই একদিন দীপ্তকে নিয়ে এসেছিলো ক্যাফেতে। তখনই পরিচয় হয় মোহরের সাথে।
দীপ্ত সেন কবিতা লেখে। মা আর ছোট বোনকে নিয়ে সংসার তার। দীপ্তর সাথে পরিচয় হওয়ার পরই যেন মোহরের ভিতরের মেয়েস্বত্তাটা জেগে উঠে। দীপ্তকে নিয়ে সময়-অসময় ভাবতে বসা, নিজের ভেতর অন্যরকম এক ভাবনা আসে মোহরের।
মোহর নিজেও একসময় লেখালেখি শুরু করে। দীপ্তর মতো কবিতা না প্রবন্ধ। তার এসব লেখা পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর থেকেই সবার চোখের যেন বিষ হয়ে উঠে মোহর। কেন? কি এমন লেখালেখি শুরু করলো তবে মোহর?
কিছুটা দীপ্তর চাপে পড়েই বিয়ে করে মোহর। বিয়ের পর দীপ্তর সাথে উঠে আসে দীপ্তদের পুরোনো রঙচটা বাড়িতে। কিন্তু এখানে মানাতে পারছে না মোহর। দীপ্তের মায়ের ব্যবহার কেমন যেন আর ছোট বোনটা ভীষণ ইচড়েঁ পাকা। মেয়ের ভুল হাত দিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরলেও দীপ্তর মা মেয়ের প্রতি অন্ধবিশ্বাসে মগ্ন। তার চোখে শুধু মোহরের একের পর এক ভুলই ধরা পড়ে। এদিকে মোহর দীপ্তকে নিয়ে আলাদা হতে চাইলে তাতে রাজি না দীপ্ত। কিন্তু এভাবে মোহর মানাতে পারছে না নিজেকে।
তাহলে এখন? কিভাবে চলবে মোহর আর দীপ্তর সংসার? আবার তার লেখালেখি নিয়েও নানান সমস্যার সম্মুখীন! কি হবে তাহলে এখন?