"মেঘ বৃষ্টি আলো" বইটির প্রথম অংশের লেখাঃ অনেক সময়ই মনে হয়, বুঝিবা পৃথিবীতে ভালােবাসার মৃত্যু ঘটে গেছে। ভালােবাসাহীনতার অসুখে ভুগছে মানুষ। অবশ্যই এটা দৃষ্টিবিভ্রম। এই উপন... See more
"মেঘ বৃষ্টি আলো" বইটির প্রথম অংশের লেখাঃ অনেক সময়ই মনে হয়, বুঝিবা পৃথিবীতে ভালােবাসার মৃত্যু ঘটে গেছে। ভালােবাসাহীনতার অসুখে ভুগছে মানুষ। অবশ্যই এটা দৃষ্টিবিভ্রম। এই উপন্যাস প্রেম ও ভালােবাসার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাহিনী। কৈশাের ও যৌবনের সন্ধিক্ষণেই একটা নিদারুণ আঘাত পেয়ে ভালােবাসায় বিশ্বাস হারিয়েছিল অনুরাধা। আর জয়শ্রীর কাছে ভালােবাসার অর্থ ছিল রূপের স্তুতি ও যৌবনের বিলাস। আর শান্তনু ভেবেছিল ভালােবাসার সার্থকতা ছাড়া জীবন অর্থহীন। তিনজনেরই বারবার ভুল হয়ে যায়। অনেক ভুল বােঝাবুঝি ও ভুল ভাঙ্গার জন্যই ভালােবাসার রহস্য এখনও অম্লান।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
কেবলই কি শরীরের আকর্ষণ? অনুরাধা বিশ্বাস করতে চায় এর বাইরেও অন্য কিছু, কিন্তু যারা তাকে চেয়েছে তারা শরীরের বেশি কিছু চায়নি তার কাছে। তাই শান্তনু আর জয়শ্রীর ভালোবাসাটা নিয়ে অনুরাধা বাজি ধরেছে নিজের সাথেই। তার কাছে শান্তনু-জয়শ্রী পৃথিবীর শেষ প্রেমিক প্রেমিকা।
শান্তনু ছটফটে স্বভাবের যুবক, অর্থনীতিতে এম এ করে এখন এই চাকরি সেই চাকরিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাবা বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাপের পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টায় শান্তনু সবসময় পরিবার থেকে দূরে দূরে থেকেছে। আলাদা ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকে, কিন্তু একটা পারিবারিক স্নেহর জন্য মন ব্যকুল তার।
প্রথম যৌবনে কিছুদিন কলেজে পড়িয়েছিল। সেখানেই তার ছাত্রী ছিল জয়শ্রী। কলেজে সেভাবে আলাদা করে খেয়াল করা হয়নি। কিন্তু পরিচয় গাঢ় হল সিমলায় আকস্মিক দেখা হয়ে। সেবারই শান্তনুর মনে হল, তার হৃদয়ের যে অংশটায় অপার শূন্যতা, এই চপলা সুন্দরী মেয়েটির মাপ যেন ঠিক সেই শূন্যতার সমান। শান্তনুর সব অস্থিরতা এবার জড়ো হলো জয়শ্রীকে পাওয়ার চাওয়াতে।
জয়শ্রীর পরিবারটা বেশ সনাতনী সংস্কার মেনে চলা। তার বাবা-মা মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, কিন্তু একেবারে ছেড়ে দিতেও পারেননি। তাদের পক্ষে শান্তনুকে মেনে নেওয়া বেশ কঠিনই বলতে হবে। এতো বাধার পড়েও চঞ্চল জয়শ্রীর মধ্যে এক একরোখা সত্ত্বা বাস করে। বিয়ে করলে সে শান্তনুকেই করবে।
অনুরাধা চেয়েছিল অন্যের উপর বাজি রেখে তার বিশ্বাস পুনরায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু এই তিন নর-নারীর কারোর সমীকরণই মিললো না। ভুল হয়ে গেলো কোথাও।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসটির গল্পটা সংক্ষেপে খুব সরল, তিনজনের ভালোবাসার গতানুগতিক কাহিনী। তাও এটা ঠিক সাধারণ প্রেমের উপন্যাস নয়, প্রেমের অনুভব আর ব্যাখার গভীর পটভূমি আছে গল্পে।
গল্পটা শান্তনু আর জয়শ্রীর ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে হলেও, এর মূল চরিত্র অনুরাধা। তাই তার নিজস্ব জগত স্থান পেয়েছে গল্পে অনেকটা। শান্ত শ্যামলা মেয়েটি, ঝিরিঝিরিয়ে হেসে বেড়ায়, কিন্তু সে প্রতিদিন বাড়ি ফেরে মন খারাপ করে। তার পথের কাঁটা হয়ে থাকে চায়ের দোকানে বসা অঞ্জন, বা দোতালার প্রনবেশদা-রা। এ নিয়ে প্রতিবাদও করতে পারে না অনুরাধা। অঞ্জনের বাবা বা প্রনবেশের স্ত্রী যদি বলেন 'অত মেয়ে থাকতে তোমার সঙ্গেই কেন ও এরকম করে?' তাতে যে অনুরাধারই অসম্মান! নারীজীবনের এই এক কঠিন অসহায়ত্ব।
চরিত্রগুলোকে খুব কম কথায় সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন সুনীল। 'শিক্ষক যদি অব্রাহ্মণ হয়, ব্রাহ্মণ ছাত্র কি তার পায়ে হাত দিতে পারে?' এই এক বাক্যে জয়শ্রীর বাবার মানসিকতাটা বুঝে ফেলা যায়। সুগতর চরিত্রকে লেখক দাঁড়া করিয়েছেন শান্তনুর বিপরীতে। তাই শান্তনু যতটা উদ্দাম, সুগত ততটাই পরিপাটি ত্রুটিহীন। শান্তনুর অন্তরের যে ছটফটানি, সেটা জয়শ্রীর দিকে যখন ধাবিত হয়, তখনই বোঝা যায় তার হিসেবে ভুল ছিল। জয়শ্রীকে আদৌ কি ভালোবেসেছে শান্তনু না সে কেবলই তার কাছে নারীত্বের একটি অপরূপ অবয়ব?
এই সাধামাটা উপন্যাসটা আমার ব্যক্তিগত পছন্দ এর দৃশ্যায়নে। সুনীল সরাসরি চোখে আঙুল দিয়ে না বলেও অনেক কিছু ব্যক্ত করেছেন লেখনী দিয়ে। (এই অংশটা স্পয়লার হতে পারে। যদিও এই ধরণের উপন্যাসে ঠিক স্পয়লার হয় কিনা জানি না, তবু কেউ চাইলে এড়িয়ে যেতে পারেন। এই বইয়ের গল্পের থেকে এর গল্প বলাটা আমার বেশী পছন্দের, তাই আলোচনা না করে পারছি না।)
শান্তনু জয়শ্রীর বাঁ পায়ের কড়ে আঙুল নিয়ে খেলা করার একটি কথোপকথন ছিল গল্পের প্রথম দিকে। গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হবার পর জয়শ্রী সুগতকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। অনুরাধা বারবার জানতে চায় শান্তনুর কি দোষ ছিল। জয়শ্রী কেবল দেখায়, সেই আঙ্গুলটা, দুর্ঘটনায় থেঁতলে গিয়েছে। আর কিছুই বলেননি লেখক, কিন্তু জয়শ্রীর চরিত্রের গভীরতা পাঠক অনুভব করতে পারবেন এই দুটো দৃশ্য থেকে।
প্রত্যাখ্যাত শান্তনু আবার ফিরে আসে অনুরাধার কাছে। তিনতলায় উঠার সময় সে পেছনে ফেলে আসে অঞ্জনকে, এরপরে প্রণবেশকে - যাদের অনুরাধা ফিরিয়ে দিয়েছে। শান্তনুকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল অনুরাধা, তার প্রতিজ্ঞা ছিল জীবনে আসা প্রথম ভালোবাসাকে সে প্রত্যাখান করবে। কিন্তু কতবার? পাথর ফেটেও একসময় জলপ্রপাত বেড়িয়ে আসে।
বই: মেঘ বৃষ্টি আলো
লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৪
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১০০
মূল্য: ১১৩ টাকা
Read More
Was this review helpful to you?
By Rejoy,
06 Jan 2022
Verified Purchase
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসে রয়েছে এক আলাদা আকর্ষণ। এটাও তার ব্যতিক্রম নয়। পড়ে ভালো লেগেছে, তবে এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় একটু মনটা খারাপ হলো, Ending টা যদিও আরো মধুর হতো