"কালপুরুষ " বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ পশ্চিমবঙ্গের অগ্নিস্রাবী রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমার শেষ পর্বে কালবেলার নায়ক অনিমেষ আশা করেছিল তার পুত্র অর্ক তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নিশানটি শক... See more
"কালপুরুষ " বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ পশ্চিমবঙ্গের অগ্নিস্রাবী রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমার শেষ পর্বে কালবেলার নায়ক অনিমেষ আশা করেছিল তার পুত্র অর্ক তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নিশানটি শক্ত হাতে বহন করে নিয়ে চলবে। কিন্তু সমকালীন অন্তঃসারহীন কুটিল রাজনীতি এবং পঙ্কিল সমাজব্যবস্থা অর্ককে করে তুলেছিল অন্ধকার অসামাজিক রাজত্বের প্রতিনিধি। তার বােধােদয় ঘটতে বিলম্ব হয়নি। যেহেতু তার রক্তের মধ্যে ছিল পিতা অনিমেষের সুস্থ আদর্শবাদ এবং তার মা মাধবীলতার দৃঢ়তা ও পবিত্রতার সংমিশ্রিত উপাদান। এক ভিন্ন মানসিকতায় সে আহ্বান শুনেছিল চিরকালীন মানবতার। একদিকে সুযােগসন্ধানী রাজনৈতিক দল এবং অপরদিকে সুবিধাবাদী সমাজব্যবস্থার যূপকাষ্ঠে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত কিছু মানুষকে একত্র করে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল নতুন ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তাদের সামনে তুলে ধরেছিল আগামী পৃথিবীর সুন্দরতম এক মানচিত্র। কিন্তু ক্ষমতালােভী রাজনৈতিক দল ও সমাজ অর্ককে অর্গলবদ্ধ করে সেই পবিত্র পৃথিবীর স্বপ্নটি ভেঙে চুরমার করতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু অর্ক যার অপর নাম সূর্য, তার আবির্ভাবকে কি চিরকালের মতাে রুদ্ধ করে রাখা যায়? উপন্যাসের পরিসমাপ্তিতে মানবতার আহ্বান এবং অনুরণন দৃশ্যমান।
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।
কালপুরুষঃ-গল্পের শুরু এক বস্তিতে। যেখানে ঠিক আগের দিনকার মত"দিন যায় রাত আসে"।সকালে উঠলে শোনা যায় পাড়ার বখাটে ছোড়ারা সমানে খিস্তি করে যাচ্ছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে যে যার ধান্ধায় বেরিয়ে পড়ছে, ছিনেমার টিকিট ব্লাক করছে,মাস্তানি করে বেড়াচ্ছে মাঝে মধ্যে বড় দাউ পেলে মের দিচ্ছে। এসব তিন নম্বর ইশ্বরপুকুর লেনের বস্তি বাসীর কাছে পরিচিত দৃশ্য। এসব নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
শুধু মাত্র মাধবীলতার পরিবার ছাড়া।এত বছর এখানে থাকার পরেও মাধবীলতা বস্তিবাসীর এসব ব্যাবহার ঠিক সহ্য করতে পারেনি। মাধবীলতা অনিমেষ এবং ছেলে অর্ককে নিয়ে এখানে বাস করে।অনিমেষ মিত্র অর্কের বাবা। যে নকশাল আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের কাছে পা দুটো হারান। গল্পে লেখক মাধবীলতা চরিত্রেটিকে অসীম মমতাময়ী এক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সংসারে যার Sacrifice উল্লেখ করা মত। অনিমেষর অক্ষমতার কারনে পুরো সংসারের চাকা যার একাই ঘোরাতে হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই তাদের একমাত্র ছেলে অর্ককে মানুষ করা।
কিন্তু পাঠক এখানে বুঝতে পারবেন একটা কিশোরের উপর পরিবেশের প্রভাব কতটা প্রকট।"কয়লার খনিতে কাজ করলে কালি লাগবে আর আতর ফ্যাকটরিতে কাজ করলে শরীর থেকে সুবাস ছাড়বে "এটা যেন লেখক চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মাধবীলতার ইচ্ছে ছিলো তাদের ছেলে পড়ালেখা করবে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরন করবে।কিন্তু একটা সময় পর তার বুঝতে বাকি রইলো না!এখানে থেকে তা সম্ভব না।তাদের ছেলে অর্ক, বস্তির অন্য দশটা ছেলের মতোই বেড়ে উঠছে খিস্তিখেউড় করে যাচ্ছে, বাবা-মায়ের মুখে মুখে তর্ক করছে। যেটা অনিমেষ এবং মাধবীলতা তাদের কেউ, শৈশবে কল্পনাই করতে পারত না।তারা এই পরিবেশ থেকে বাইরে ভালো পরিবেশে যেতে চাইলেও নিয়তি তাতে সায় দিচ্ছিলো না।এভাবেই চলতে থাকলো অর্ক এবং ইশ্বরপুকর লেনের বস্তি বাসীর জীবন। হঠাৎ একদিন অনিমেষদের জলপাইগুড়ির বাড়ি থেকে ডাক আসলো। তাদের সেখানে যেতে বলা হল।অনিমেষের অমত থাকা সত্ত্বেও মাধবীলতা এবং অর্কের আগ্রহের কারনে তারা এক রাতের ট্রেনে জলপাইগুড়ি উপস্থিত। এখানে আসার পর শুধু যে মাধবীলতা এবং অনিমেষ বুঝলো তাই না।অর্ক নিজেও তার ভিতরে পরিবর্তন লক্ষ করলো। সে বুঝতে পারছে তার বন্ধুদের ওসব গালিগালাজ মাস্তানী আসলে ভালো কিছু নয়।একটা সুস্থ পরিবেশ পেয়ে তার চিন্তা ভাবনা গুলোও সুস্থ হতে শুরু করলো।
ঠিক সময় এক রাতে এই জলপাইগুড়ির বাড়িতেই লেখক গল্পের ট্রাজেডি ডেকে আনলেন। গভীর রাতে অর্কের ঘুম ভাংলে সে শোনে তার বাবা -মায়ের ঘরে কথা শোনা যাচ্ছে। দরজার কাছে দাড়াতেই সে কথা গুলো আরো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। এই কথা গুলোর ভেতরে একটা শব্দ শুনে সে স্তব্ধ হয়ে গেল এবং সে বুঝতে পারছে মুহূর্তেই তার শরীরে জ্বলুনি শুরু হয়ে গেছে। "বাস্টার্ড " বাস্টার্ড মানে কী?
তার মানে তার বাবা-মার কখনো বিয়েই হয়নি?এই পৃথিবীতে তার কোনো মূল্যবোধ নেই! সে শুধুমাত্র দুটো মানুষের চরম উন্মাদনার ফসল।এই চিন্তা অর্কের চিন্তা জগৎ কে কিছুক্ষণের মধ্যে এলোমেলো করে ফেললো। এবং এক রাতেই অর্ক বুঝলো সে এখন আর সেই আগের অর্ক নেই।হঠাৎ করেই সে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। সে যেন এখন অনেক দায়িত্ব জানে।
এবং অনিমেষ মাধবীলতার বিচ্ছেদ ঘটে গেল।
এর পরে যে গল্পটুকু আছে সেটা শুনে মনে হবে গল্পকথক বুঝি টলি-পাড়ার কোনো ছিনেমার গল্প বলে যাচ্ছেন। তবে এখানে একটা কথা বলে রাখি।যারা লেখক হতে চাচ্ছেন বা গল্প বানাতে চাচ্ছেন তারা একটু লক্ষ্য করলেই এখান থেকে গল্প তৈরির কিছু ক্রিয়াকৌশল ধরতে পারবেন। বুঝতে পারবেন কেন পাঠক বিনা ক্লান্তিতে একটার পর একটা পাতা ওল্টায়।
আর হ্যা,অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে অর্কের জীবনে কি কখনো প্রেম এসেছিলো,, উত্তর হ্যা না দুটোই।
আর মাধবীলতা এবং অনিমেষ কী কখনো এক হতে পেরেছে? এর উত্তর বইটা পড়লে জানতে পারবেন।
Read More
Was this review helpful to you?
By Mahbuba Supti,
25 Jun 2017
Verified Purchase
"কালবেলা" উপন্যাসের পরের অংশ নিয়ে তৈরী "কালপুরুষ" উপন্যাসের কাহিনী। "কালবেলা"র শেষ অংশে দেখা যায়, অনিমেষ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মাধবীলতার সাথে আসে। ততদিনে মাধবীলতা আর অনিমেষের সন্তান অর্ক এসেছে পৃথিবীতে।
তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনের এক বস্তি ঘরে বড় হচ্ছে অর্ক। অনিমেষ আর মাধবীলতার একমাত্র সন্তান। অর্ক নামটা মাধবীই রেখেছিলো। অর্ক মানে সূর্য। কিন্তু এই বস্তি ঘরে অর্ক মানটা কতটুক মানানসই? ঈশ্বরপুকুর লেনের এই ঘুপচি ঘরের আশেপাশের নোংরা পরিবেশে বড় হয়ে উঠা অর্ককে নিয়ে সারাক্ষণ ভয়ে থাকে মাধবীলতা।
একটি স্কুলে পড়িয়ে সংসার চালাচ্ছে মাধবীলতা। পুলিশ নির্যাতনের স্বীকার হয়ে পঙ্গু অসহায় অনিমেষ। মাধবীলতার সামর্থ্য নেই খুব ভালো একটা জায়গায় থাকার। তাই এই বস্তিতে বড় হয়ে উঠতে হচ্ছে অর্কের। একটা সময় পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে বস্তির পরিবেশের সাথে। কিলা, খুরকি, বিলা এরাই হয়ে উঠে অর্কের বন্ধু।
এই পরিবেশে বড় হয়ে উঠা অর্কের সাথে পরিচয় হয় সমাজের উচ্চস্তরের কিছু মানুষের সাথে। যেসব চেহারা সে কখনে দেখেনি। সে পরিচিত না এই পরিবেশের সাথে। তাই তো ঘরে ফিরার পর শুধু তার বমি পায়। এসব দেখেই সে বদলে নেয় নিজেকে। শুরু হয় তার অন্য আরেক সংগ্রাম। সমাজের অন্যায়কে দূর করার চেষ্টায় নামে। তাদের বস্তির সকল মানুষকে তিনবেলা খাওয়ানোর দায়িত্ব নেই। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে। বস্তির মানুষগুলো যেমন বেচেঁ থাকার নতুন আশা খুজেঁ পায় তেমনি ছেলের পরিবর্তনে মাধবীলতা, অনিমেষও সুখ খুজেঁ পায়। কিন্তু অর্ক কি পারবে শেষ পর্যন্ত এই মানুষগুলোর মুখে হাসি ধরে রাখতে? নাকি সব লন্ডভন্ড হয়ে যাবে কোন এক ঝড়ে?
Read More
Was this review helpful to you?
By Sohel ,
06 Nov 2019
Verified Purchase
"উত্তরাধিকার" ও "কালবেলা" উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহ ধরে লেখা "কালপুরুষ" সমরেশ মজুমদারের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। 'কালবেলা' উপন্যাসে অনিমেষ যে ফসল বুনেছিল এই উপন্যাসে তা চারা গাছ হয়ে একটু একটু করে বড় হতে থাকে! অনিমেষ আর মাধবীলতার ভালোবাসার ফসল অর্ক। নামটা মাধবীলতার দেয়া। তাদের নিস্তব্ধ জীবনের সূর্য যেন অর্ক। পঙ্গু স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে বস্তির এক বাড়িতে মাধবীলতার বাস! পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে সব সময় কি একটা ভয়ে থাকে মাধবীলতা! বস্তিতে থাকার মাশুল অবশ্য দিতে হয় তাদের। স্কুল আর ঋণের চাপে জর্জরিত মাধবীলতা আর পুলিশের অত্যাচারে পঙ্গু অসহায় অনিমেষের শত সতর্কতার পরও অর্ক আস্তে আস্তে বস্তির পরিবেশে আসক্ত হয়ে পরে। কিলা, খুরকি, বিলা এরাই হয়ে ওঠে অর্কর নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে অন্য একটা ঘটনায় সমাজের উচু তলার কিছু মানুষগুলোর আসল চেহারাটা সামনে আসে অর্কর। ঘটনার তীব্রতায় জ্বর চলে আসে তার। এতবড় ছেলে মায়ের আচলে মুখ গুজে খালি বলে চলে বমি পাচ্ছে মা। কতটা নোংরা কদর্যতা দেখলে একটা ছেলে এমন কথা বলতে পারে এইসব ভেবে তীব্র প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে ওঠে অর্ক। নিজের সাথে নিজেই প্রতিজ্ঞা করে সমাজের এসব অসঙ্গতির সাথে কখনোই তাল মেলাবে না। তারপর তাকে বস্তির লোকজনকে সাথে নিয়ে নতুন এক আন্দোলনে সামিল হতে দেখা যায়। এক পরিবার এক হাড়ি হিসেব করে পুরো বস্তিকে সাথে নিয়ে শুরু করে এক অবাক করার মতো কাজ। নির্দিষ্ট একটা অর্থের বিনিময়ে সারা মাস তিনবেলা সবাইকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয় সে। এসব দেখেশুনে আশার সঞ্চার হয় অনিমেষ -মাধবীলতার মনে। এভাবে এগিয়ে যায় কাহিনী।